• বদরুল ইসলাম বাদল

আজ মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও ন্যায্য দাবি আদায়ের দিন।এই দিনের রক্তঝরা আন্দোলনে শ্রমিকদের দৈনিক কাজের সময় আট ঘন্টা নির্ধারিত হয়।তাই এই দিনটি “আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস” হিসেবে পরিচিত ।বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি যাদের আত্মবলিদানে মেহনতী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সে সব মহান শ্রমিকদের প্রতি।

প্রতিদিন সভ্যতা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে।যুগের পর যুগ মানুষ তার কায়িক শ্রম ও মেধাশক্তি দিয়ে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে । আর সভ্যতার এই নব রুপায়ন ঘটেছে শ্রমিকের কায়িক শ্রমের হাতুড়ি, কাস্তে এবং রক্ত পানি করা ঘামে।তাই আধুনিক সভ্যতার অগ্রযাত্রায় শ্রমিক শ্রেণির অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু সভ্যতার গুড়া থেকে শ্রমিক শ্রেণি সব সময় বঞ্চনার ,বৈষম্যে স্বীকার।মর্যাদাহীন হয়ে শুধু খেটেই আসছে । সূর্যউদয় হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কাজ করতে হতো।কাজের সময়ের কোন লিমিট ছিল না।কিন্তু পেতেন না উপযুক্ত মুজুরী। ছিল না কোন সুযোগ সুবিধা,নিরাপদ নিরাপত্তা ।লেগেই থাকতো মালিক পক্ষের দূর্ব্যবহার । দাসদাসী হিসেবে মনে করত।চালানো হতো নানাবিধ শারীরিক ও মানষিক অত্যাচার।অথচ এই শ্রমিকদের রক্তঝরা কঠোর পরিশ্রমে মালিকপক্ষ অঢেল টাকার মালিক।পুঁজিপতি। একপর্যায়ে এধরণের বৈষম্য অসহনীয় হয়ে গেলে শ্রমিক শ্রেণি একতাবদ্ধ হয়ে গড়ে তুলে আন্দোলন।1886 সালের এইদিনে আমেরিকার সব শিল্পপ্রতিষ্টানে ধর্মঘট করে শ্রমিক ইউনিয়ন।উপযুক্ত মুজুরী আর কাজের সময় আট ঘন্টা নির্ধারণের দাবি নিয়ে চলে বিক্ষোভ। আন্দোলনের তীব্রতায় মালিক গোষ্ঠী দিশেহারা হয়ে যায়। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ লেলিয়ে দেয়।পহেলা মের এই দিনে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে বিশাল শ্রমিক বিক্ষোভের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়। রাজপথেই এগারজন আন্দোলনকারী শ্রমিক প্রাণ হারান। বিক্ষোভ বানচাল করার জন্য আটক করা হয় অনেক শ্রমিক। পরে আটককৃত কয়েকজন কে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ঝুলানো হয় ফাঁসিতে।কারাগারে অন্তরীন একজন শ্রমিক আত্নহত্যাও করে।তারপর ও শ্রমিকদের দাবী আদায়ের দুর্বার আন্দোলন স্তব্ধ করতে ব্যর্থ হয় কতৃপক্ষ।আমেরিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশে ছড়িয়ে পড়ে শ্রমিক আন্দোলন। পরিশেষে বাধ্য হয়ে 1890 সালে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়।।সেই থেকে কাজের সময় আট ঘন্টা আইনি সৃকৃতি পায়।মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের জয় হয়।তাই এই রক্তাক্ত দিনটি স্মরণ রাখতে সেই সময় থেকে মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হয়ে আসছে।

বিশ্ব সভ্যতার প্রতিটি সৃষ্টির মূলে রয়েছে মানুষের শ্রম। মজুর,চাষি, কুলি,কামার, ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক নিজেদের কায়িকশ্রমে সংশ্লিষ্ট কাজে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখে।কিন্ত এত বছর পরে ও দেশে দেশে দেখা যায় শ্রমিকদের নুন্যতম মর্যাদা টুকু আজোও অবহেলিত।কথায় কথায় ছাটাই, কাজের জায়গায় নিরাপত্তাহীনতা,অসাস্থ্যকর পরিবেশ ইত্যাদিতে শ্রমিকদের আত্মমর্যাদার লড়াই আজোও এদেশে থামে নাই।হাড়ঁভাঙ্গা খাটুনি দিয়ে পায় না উপযুক্ত পারিশ্রমিক। ক্ষেতে চাষিরা পাচ্ছে না ফসলের ন্যায়্য দাম,দালাল ফড়িয়াদের ধূর্ততার স্বীকার চাষী।লবণ মালিকের সিন্ডিকেটের কারণে লবণ চাষি লোকসানে যাচ্ছে প্রতিবছর। তাই শ্রমজীবী মানুষ দিনদিন নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে অপর দিকে ধনীক শ্রেণির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশ্বকবি রবি ঠাকুর তারএকটি লেখাতে শ্রমজীবী মানুষের কথা তুলে ধরেন এভাবে, “সবচেয়ে কম খেয়ে কম পরে কম শিখে বাকি সকলের পরিচর্যা করে। সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান। তারা রোগে মরে,উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি -ঝাঁটা খেয়ে মরে। তারা সভ্যতার পিলসুজ মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে উপরের সবাই আলো পায়।তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে”।

শ্রমজীবি মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের মহান “মে দিবস” আজ।কিন্তু অনেক শ্রমিক কৃষক আজকের দিনে যে “মে দিবস” সেটা জানেও না,জানে না মে দিবসের তাৎপর্য এবং গুরুত্ব।সভ্যতা দিবসটি আনুষ্ঠানিক ভাবে পালন করেই শেষ করে।তবে আমাদের উচিত আধুনিক সভ্যতা সৃষ্টির কারিগর শ্রমিকদের যথাযথ সন্মান জানানো।আন্তরিকতা, সহমর্মিতা নিয়ে তাদের পাশে দাড়ানো। এনিয়ে একজন বিশ্লেষক পরামর্শ সহকারে বলেন ,”মে দিবসে কোনও কর্মী খুঁজে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করো।শ্রমিক না থাকলে কোন সভ্যতা তৈরি করা যেত না।”সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে 1972 থেকে “মে দিবস” পালিত হয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এই দিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষন রাখেন।পহেলা মে সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন।বঙ্গবন্ধু আজীবন শোষিত, বঞ্চিত, মেহনতী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। শ্রেণি বৈষম্য কমানো ও দুঃখী মানুষের হাসি ফোটানোর জন্য তিনি ছিলেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি গরীব দুঃখী অসহায় মানুষদের সব সময় সন্মান করতেন। 1975 সালের এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু চাকরিজীবীদের উদ্দেশ্য বলেন, “আপনি চাকরি করেন, আপনার মায়না দেয় ঐ গরীব কৃষক। আপনার মায়না দেয় ঐ গরীব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ঐ টাকায়।আমি গাড়ি নিয়ে চলি ঐ টাকায় । ওদের সন্মান করে কথা বলুন। ওদের ইজ্জত করে কথা বলুন।ওরাই মালিক”। আজকের মে দিবসে বঙ্গবন্ধুর এই কথা গুলো স্মরণে এনে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত।এদের ইজ্জত দিলে তাদের সেরাটা তারা দেশের জন্য উপহার দেবে । কোভিড মহামারীর পর বিশ্ব অর্থনৈতিক অবস্থা দেউলিয়াত্বের কাছাকাছি। শ্রীলঙ্কা সহ অনেক দেশে তা পরীলক্কিত হচ্ছে। তাই দেশীয় অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করতে না পারলে দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।তাই দরকার মালিক শ্রমিকের একাত্মা,সম্প্রীতির বন্ধন এবং “মে দিবস” এর অন্তর্নিহিত মর্ম অনুধাবন করে শ্রমিকদের যথাযথ মুল্যায়ন।

কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা সমস্যা একটি বড় সমস্যা।পরিবেশ, সামাজিক সংস্কৃতি বিনষ্টের পাশাপাশি দেশীয় শ্রম বাজার ও রোহিঙ্গারা দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে। সবধরনের সুবিধা পাওয়ার পর ও রোহিঙ্গারা লোভ থেকে রোজগারের জন্য ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে জেলার বিভিন্ন জায়গায় সস্তায় শ্রম বিক্রি করছে।যা বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে। সকালে কক্সবাজার ঘুনগাছ তলায় গেলে তার সত্যতা পাওয়া যাবে।প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের বাইরে ও দেশীয় অনেক শ্রমিক দিনমজুরের কাজ করে থাকে ।রোহিঙ্গাদের কারণে তারা কাজ হারাচ্ছে। তাই প্রশাসনের সেদিকে নজর দেওয়া দরকার বলে মনে করেন সচেতন মহল।না হলে কক্সবাজারের দিনমজুর শ্রমিক হারিয়ে ফেলবে এখানকার শ্রমবাজার।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রূপকল্প 2041 ঘোষণা করেছেন।কোভিড পরিস্থিতির পর এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে গেছে।এই অবস্থায় কাজের মধ্যে শ্রমিকদের আন্তরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারলে জটিল হবে সমীকরণ। তাই আজকের ‘”মে দিবসে” সুবিশাল শ্রমিক শ্রেণির যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেওয়ার শপথ হউক। গড়ে উঠুক শ্রমিক মালিক সুসম্পর্ক, ন্যায্য মুজুরী নির্ধারণ। এই হোক পহেলা মে দিবসের অঙ্গীকার।দার্শনিক ভাষায়,”মে দিবস কোনও সাধারণ দিন নয় কারণ এটি এমন এক দিন যা অসাধারণ মানুষ শ্রমিকদের লালন করে। “তাই মে দিবসের শপথ হউক শ্রমিক শোষণ ও বৈষম্যের অবসান।
জয় বাংলা।


কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।
সাবেক ছাত্র নেতা।